হযরত মখদুম কেয়ামুদ্দিন আউলিয়া’ (রহঃ) ১১ হিজরির কোন এক সময় মদিনা হতে ৬/৭ কিলো উত্তর পূর্বে খলিফাতুর রাসুল (দঃ) ফারুকে আজম (রাঃ) এর বংশে হযরত আমিরুল বংশধর হযরত আলী উদ্দীন খাঁ (রহঃ) এর ঘরে কনিষ্ঠ পুত্র হিসাবে ভূমিষ্ঠ হন।প্রথমে প্রাথমিক শিক্ষা পিতার থেকে গ্রহণ করে মদিনায় মসজিদে নব্বীতেই হাদিছ ও তাফসিরের দরসে যোগ দান করে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করেন। এবং মক্কাতুল মুকাররমার ফিকহি দরস হতে হানাফি মাশায়েখদের সনদ অর্জন করেন। মদিনায় গিয়ে বিবাহ এবং তাফসির হাদিছ ও ফিকহে হানাফির দরস শুরু করেন। এই সময় ইরাক ইরান জর্ডান ও ফিলিস্তিন পথে দ্বীনি তাবলিগ ও দরসের জন্য ভ্রমণ করেন। অবশেষে মদিনায় তিঁনি ৫ মেয়ে ৩ ছেলে রেখে ৬ষ্ঠ মেয়ে রোকাইয়া ও স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ভারতের দিকে তাবলিগ (দ্বীন প্রচার) ও তাসাউফ চর্চার উদ্দেশ্যে নিয়ে হিজরত করেন। ২ বিহারে হযরত কুতুবে চাটগাঁম শাহ সূফি আমানত নুয়াইম আল আরবী (রহ.) হাতে চিস্তিয়ায়ে মুজাদ্দাদীয়া তরিকায় বায়াত গ্রহণ করেন। এবং অল্প দিনেই খেলাফত ও আমানত অর্জন করেন। মুরশিদের নির্দেশে ঝাড়খান্ড এর সোন নদীর পাড়ে খানকাহ্ স্থাপন করে দ্বিনি তাবলিগ ও রেয়াজতে মাশগুল হন। তিঁনি আরবি উর্দ্দূ, ফার্সির ভাষি হওয়ার কারণে দ্বীনি দাওয়াতি কাজে অগ্রগতি না হলে পীরের নিদেশে মধুরামী ও দেবনাগরী অক্ষরে বাংলা, সাংস্কৃতি ও হিন্দি ভাষা শিক্ষা অর্জন করেন। তাঁহার নাতি, কেরামত, মিষ্টি ভাষায় দাওয়াতি আহবানে অসংখ্য লোক ইসলাম গ্রহণ করেন। চারিদিকে তাহার নাম প্রচার প্রসার হয়ে যায়। সোনপুর খানকাহ্ শরীফ এক দ্বিনী বাগানে পরিণত হয়ে উঠে। ১৭৭১ ইংরেজী সালে ঝাড়খন্ডের আদিবাসীরা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বারংবার বিদ্রোহের ধারাবাকিতা শুরু করে। তখন কিছু হিন্দু কট্টরপন্থি সন্ত্রাসবাদির ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সংখ্যালগু মুসলমানদের উপর নির্যাতন আরম্ভ করে। ঝাড়খন্ড আদিবাসী নওমসলিম ও আদি মুসলিমদের কাছে এই কট্টরপন্থি হিন্দু সম্প্রদায় প্রস্তাব দেয় যদি এই মুসলিম দরবেশ এখান হতে চলে যায় তাহলে তোমরা নিরাপদে থাকতে পারবে। মুসলিমগণ এই প্রস্তাব প্রত্যাক্ষান করে । অবশেষে হিন্দু কট্টরপন্থিগণ এই মহান আউলিয়া (হত্যা) শহিদ করার পরিকল্পনা করে।
একদিন হযরত মাখদুম কেয়ামুদ্দীন আউলিয়া (রহ.) তাঁর পীর শাহ আমানত আরবী (রহ.) ও হুজুর পুরনুর রাসুলুল্লাহ্ (দ.) কে স্বপ্নে দেখেন। হজুর (দ.) শাহ্ কেয়ামুদ্দীন আউলিয়া কে বলছেন, বাবা কেয়ামুদ্দীন আপনার আবস্থা আমি জানতে পেরেছি। আপনি পূর্ব বাংলায় গমণ করেন সেখানে গিয়ে আমার ও আপনার পীরের দেয়া আমানত তথা স্থানে পৌছাইয়া দেন। আজ রাতই হিজরত করুন। ৪ হযরত কেয়ামুদ্দীন আউলিয়া (রহ) ঐ রাতেই ১১৭৮ বাংলা ১৭৭১ ইংরেজী সোল নদীতে গিয়ে পাথরে আরোহন করে ফেনী নদীর মুহনায় আসেন। ৫ উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো হযরতের সাথে তার বিবি চলে আসেন পরবর্তি কোন এক বুর্জুগের সাহায্যে হযরতের মেয়ে রোকাইয়াও এই স্থানে চলে আসেন। ৬ ততকালিন ফেনীর দক্ষিণে হাজিগাঁও বর্তমান মিরস্বরাই এর হাজীস্বরাই গ্রামে হুজুর বসতি স্থাপন করেন। ৭ এই প্রসঙ্গে স্বয়ং তাঁর খলিফা শাহ্ আলী রজা কানু শাহ্ (রহ.) লিখেন;
ফেনীর দক্ষিণে এক শহর উপাম
হাজীগাঁও করিছিল সেই দেশের নাম,
সেই শুভ গ্রামে ছিল তাহার বসতি
সেই পীর চরণে মোর সহস্র প্রণতি-
৮ হযরত শাহ্ সুফি কালু শাহ্ (রহ.) হযরত কালা শাহ (রহ.) হযরত চিন কি শাহ্ (রহ.) প্রমুখ এখানেই হযরতের হাতে বায়াত গ্রহণ করেন। ৯ এইখানে তিনি পূর্বের ন্যায় দাওয়াতি ও তাসাউফের কর্ম কাজ শুরু করেন। নবাবগণের জরিপ কালে তাহার কর্মকান্ডে খুশি হয়ে তাহাকে কিছু ভ‚মিসম্পত্তি দিতে চাহিলে, তিনি নিজের জন্য গ্রহণে আপত্তি প্রকাশ করেন। তখন হযরতের বিশেষ সহচর হযরত কালা মুস্তান শাহ্ (রহ.) এর নামে জরিপ হয়। ১০ যা কালার তানুক নামে এখানো পরিচিত। হযরত কালা মুস্তানের নামেই বর্তমান এই মিরস্বরাইয়ের মুস্তান নগর হযরত শাহ্ সুফি কালা মুস্তান (রহ.) কে হযরত কেয়ামুদ্দীন আউলিয়া (রহ.) তরিকার দায়িত্ব অর্পন করে দেশ এবং তার মেয়ে রোকাইয়া কে তাঁরই খলিফা চিন কি শাহ্ (রহ.) এর নিকট বিবাহ দেন এই বৎসর তাঁহার স্ত্রী ইন্তেকাল করেন। ১১ এরপর তার পীরের ও রাসুল (দ.)এর দেয়া কাজে মনোনিবেশ করেন এবং বর্তমান চট্টগ্রামের পরৈকোড়া আসেন। এই হিসেবে বলা যায় তিনি ১১৩৪ মঘি ১১৭৯ বাংলা ১৭৭২ খ্রীষ্টাব্দের শুরুতে কোন এক সময় শাহ্ কালাকে খেলাফত দেন এবং মেয়ের বিবাহ দেন। সেই বৎসর ১লা কার্তিক তিনি শাহ্ সুফি আলী রজা কানু শাহ্ (রহ.) কে ১৩ বৎসর বয়সে বায়াত করান।
হযরত কেবলা মখদুম শাহ্ সুফি কেয়ামুদ্দীন আউলিয়া শাহ সুফি আলী রজা (রহ.) কে বায়াত করানোর পর তাকে হাদিছ, তাফছির ও ফিকহার বিষয়ে উচ্চ পড়াশুনা করান। এবং লালানগর বাজারের পশ্চিমে জমিদার বাড়িতে শিক্ষক হিসেবে চাকুরি নেন। দীর্ঘদিন এখানে চাকুরি করতেন আর শাহ্ আলী রজা (রহ.) কে জাহেরি বিদ্যায় পারদর্শি করে তুলেন। তাহাকে খেলাফত ও সাধনের জন্য বনবাসী হওয়ার এজাজত দিয়ে ১১৪৫ বা ১১৪৬ মঘি ১৭৮৪ খ্রীষ্টাব্দের কোন এক সময় সেখান হতে পুনরায় মিরস্বরাইয়ে ফিরে যান। খানকাহ্ এর দায়িত্ব শাহ্ কালা মুস্তান কে অর্পন করে এবং আমানত সঠিক ভাবে আলী রজা (রহ.) এর নিকট পৌছিয়ে দিয়ে এখন হযরত কেবলা কেয়ামুদ্দীন আউলিয়া একাগ্রচিত্তে এবাদত ও রেয়াজতে মশগুল হলেন। তারই খেদমতে তাহার সুবিধায় হযরত কালা মুস্তান শাহ্ মস্তান নগরের পূর্ব দিকে পাহাড়ের নির্জন জনমানবহীন নিরব স্থানে একটি ছোট টিলায় হুজরা স্থাপন করে দেন। হযরত কেয়ামুদ্দীন আউলিয়া (রহ.) এই হুজরায় বাকি জীবন কাটিয়ে দেন। এই স্থানের নাম সোনাই পাহাড়। এইখানেই বর্তমান মখদুম শাহ্ সুফি কেয়ামুদ্দীন আউলিয়া কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠিত। তাহার বিশিষ্ট খলিফাগণ হলো। হযরত শাহ্ সুফি কালু শাহ্ (রহ.) হযরত কালা মুস্তান শাহ্ (রহ.) হযরত কেয়ামুদ্দীন কালা (রহ.) হযরত চিনকি শাহ্ (রহ.) হযরত লালা শাহ্ (রহ.) এবং হযরত শাহ্ সুফি আলী রজা কানু শাহ্ (রহ.) প্রমুখ। ১২ রাসুুল (দ.) এর অবয়ব বর্ণনায় তার রচিত পুস্তিকা ‘রাসুলনামা’র একটি কপি আমাদের নিকট সংরক্ষিত আছে।
এই মহান আল্লাহর অলী ১১৫২ মঘি ১৩ই ফাল্গুন ১৭৯০ খ্রীষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। ১৩ প্রতি বছর ১৩ ফাল্গুন ২৫ শে ফেব্রæয়ারী মিরস্বরাই, মস্তান নগর, দক্ষিণ সোনাই পাহাড়, জামগাছতল তাহার বাষিক ইছালে ছাওয়াব ফাতেহা শরীফ অনুষ্ঠিত হয়। এখানে হযরত শাহ্ সুফি আলী রজা কানু শাহ্ (রহ.) এর নাতি দরবেশ শাহ্ নুর মৌলা (রহ.) একটি মসজিদ, মাদ্রাসা নির্মাণ করেন এবং মাজার শরীফ কে পূর্ণ সংস্কার করে দেন।
রচিত
গোলামে আহলে বাইতে রাসুল (দ.)
মীর ফখরে হাবিবুল্লাহ্ মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন আল কুরাইশী
leave your comments